লাইফ স্টাইল রিপোর্ট:- ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অনিয়মিত জীবনযাপন, অতিরিক্ত কোলেস্টরেলের কারণে হৃদরোগ বাড়ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, দেশে হৃদরোগে বয়স্কদের চেয়ে তরুণদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে বেশি। বয়স্কদের চেয়ে ৩৫ বছরের কমবয়সীদের মৃত্যু ১৭ গুণ বেশি। মৃত্যুঝুঁকির বেড়ে যাওয়ার জন্য তারা অন্যান্য অনিয়মের পাশাপাশি প্রান্তিক চিকিৎসার অভাবকেও দায়ী করছেন। একইসঙ্গে তারা হৃদরোগ প্রতিরোধে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলজি বিভাগের ইউনিট প্রধান ও বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ডা. এম এম মোস্তফা জামান ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘বিএসএমএমইউতে আমার করা গবেষণায় দেখেছি, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে হৃদরোগে বয়স্কদের চেয়ে ৩৫ বছরের কমবয়সীদের মৃত্যু ১৭ গুণ বেশি। এখানে ধূমপান ও ভাত খাওয়ার অভ্যাস বেশি।’
এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘দেশে ১১৫টি করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) আছে। এছাড়া, এনজিওগ্রাম-এনজিওপ্লাস্টির মেশিন আছে। সবই প্রায় ঢাকা শহর বা এর আশেপাশে। আমাদের হৃদরোগের চিকিৎসাকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিতে হবে। ডায়াবেটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটা জাতীয় গাইডলাইন আছে। কমিউনিটি ক্লিনিকও এটা অনুসরণ করে চিকিৎসা দিতে পারে। হৃদরোগের ক্ষেত্রে এমন গাইডলাইন করার প্রস্তাব দিয়েছি।’
হৃদরোগে সহজলভ্য প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে ডা. মোস্তফা জামান ইত্তেফাক আরও বলেন, ‘একটা মোবাইল অ্যাপ করা যেতে পারে। একটা জরুরি রোগীকে কী ইঞ্জেকশন বা ওষুধ দিতে হবে, সেটা তাতে পাওয়া যাবে। রোগীকে কোন জায়গায় নিতে হবে,তাও সেখানে পাওয়া যাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজির প্রধান অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক বলেন, ‘দেশে হৃদরোগী বেড়ে যাওয়ার কয়েকটা কারণ আছে। আমাদের অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। এগুলো আমাদের প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে আমাদের ওপর বাড়তি মানসিক চাপ পড়ছে। এই চাপ বাড়াচ্ছে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস।’ তিনি আরও বলেন, ‘হৃদরোগ বাঁচতে প্রথমে মানসিক চাপ কমাতে হবে। দ্বিতীয়ত খাদ্যাভাস পাল্টাতে হবে। আগে দেশের মানুষ কায়িক শ্রম করততো, হাঁটতো, কৃষিকাজ করতো। এখন তো সব অফিস-আদালতে বসে। এছাড়া ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতাও হৃদরোগের জন্য দায়ী। কারণ, এগুলোতে একধরনের লবণ থাকে। এ থেকে হৃদরোগ তো হয়ই, কিডনির রোগও হয়।’
খাদ্যাভাস পরিবর্তনের প্রসঙ্গে ডা. হারিসুল হক বলেন, ‘প্রচুর পরিমাণ মৌসুমি ফল ও শাকসবজি খেতে হবে। ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। লবণ খাওয়া কমাতে হবে। ডায়াবেটিস থাকুক বা না থাকুক; চিনি ও শর্করা জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। আবার সব তেল কিন্তু ক্ষতির কারণ নয়। খাবারে সূর্যমুখীর তেল, সরিষার তেল, নারিকেল তেল ভালো। সপ্তাহে এক-দুইদিন নারিকেল তেল খেতে পারেন। মাসে তিন দিন বাদাম তেল খাওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বিষাক্ত হচ্ছে পাম অয়েল। ভেষজ তেলের দিকে মনোযোগী হতে হবে।’
বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফি মজুমদার ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘বিশ্ব হার্ট দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ করা। কারণ এই রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। তাই রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করতে পারলে ভালো। কিন্তু এখনো মানুষকে সচেতন করা সম্ভব হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নামে একটা এসিড থাকে খাবারে। বিশেষ করে ফাস্টফুডে বেশি থাকে। আমরা এসবই বেশি খাই। দক্ষিণ এশিয়ায় ডায়াবেটিসও মহামারির মতো বাড়ছে। এটাও হৃদরোগের একটা বড় কারণ। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টরেলও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে আসবে।’
দেশে হৃদরোগের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে ডা. সাফি বলেন, ‘বড় শহরের বাইরে তেমন হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসা সুবিধাও নেই। প্রতিটি জেলা হাসপাতালে একটি করে বিশেষ হৃদরোগ চিকিৎসা ইউনিট স্থাপন করতে পারলে এই রোগে মৃত্যু কমানো সম্ভব। কারণ হৃদরোগের চিকিৎসা দিতে হয় দ্রুত। রোগী এলে আমরা হিসাব করি ৯০ মিনিটের মধ্যে এলো কি না, ১২০ মিনিটের মধ্যে এলো কি না। দ্রুত চিকিৎসাই মৃত্যু কমাতে পারে। এসব জেলা ইউনিট চালানোর জন্য ডাক্তারের পাশাপাশি দক্ষ নার্স ও টেকনিশিয়ানও লাগবে।’
গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের সিনিয়র রেজিস্ট্রার ডা. তনিমা আঁখি ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের এখন খাওয়া-দাওয়ার প্যাটার্ন ঠিক নেই। দেখা যাচ্ছে, ৩০ বছর বয়স হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। এটাকে আমরা এমআই বলি। আমরা বেশিরভাগ সময় বসে বসে কাজ করি, হাঁটাহাঁটি কম করি। মূল ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যতটুকু ক্যালোরি গ্রহণ করি, ততটুকু খরচ করি না । তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।’ বছরে একবার ফুল মেডিক্যাল চেকআপ করাতে হবে বলেও তিনি মনে করেন।
উল্লেখ্য, বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব হার্ট দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘হৃদয় দিয়ে হৃদযন্ত্রের যত্ন নিন’। জানা গেছে, প্রতিবছর দেশে অসংক্রামক রোগে ১ লাখ ১২ হাজার মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় হৃদ্রোগজনিত কারণে। যার পরিমাণ ৪০ হাজার।(সৌজন্যে-দৈনিক ইত্তেফাক)
কমেন্ট করুন